এক ধরনের মাদক। এটি মেথামফেটামিন এবং ক্যাফেইনের মিশ্রণ। ইয়াবা মূল শব্দটি থাই ভাষা থেকে এসেছে। এর বাংলা অর্থ ‘পাগলা ওষুধ’। অনেকে একে ‘Crazy Medicine ’ বলে থাকেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইয়াবা আবিষ্কৃত হয়। দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা সৈন্যদের ক্লান্তি দূর করতে জার্মান প্রেসিডেন্ট অ্যাডলফ হিটলারের নির্দেশে ইয়াবা উদ্ভাবন করা হয়। দেশটির বিজ্ঞানীরা পাঁচ মাসের প্রচেষ্টায় এটি তৈরি করেছেন।
ইয়াবা মুলত কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে এবং তা ককেইন এর চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী। প্রথমদিকে ইয়াবা যৌনউত্তেজক বড়ি হিসাবে বাজারে পরিচিত ছিলো। কিন্তু দীর্ঘদিন সেবনের ফলে যৌন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। যুক্তরাজ্যের ড্রাগ ইনফরমেশন এর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী ইয়াবা ট্যাবলেটি খেলে সাময়িক ভাবে উদ্দীপনা বেড়ে যায়। কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হেরোইনের চেয়েও ভয়াবহ। একসময় যা সর্দি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ওষুধ হিসেবে ব্যবহূত হতো কোনো কোনো দেশে। ব্যবহার করা হতো ওজন কমানোর চিকিৎসায়ও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ক্লান্তি দূর করতে ও সজাগ থাকতে সেনাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল মেথঅ্যামফিটামিন। পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষ বিশেষত শিক্ষার্থী, দীর্ঘযাত্রার গাড়িচালক ও দৌড়বিদেরা এটি ব্যবহার শুরু করেন। ধীরে ধীরে এর কুফল বা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া উদ্ঘাটিত হতে থাকায় বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। তবে বিশ্বের কয়েকটি দেশে এর উৎপাদন চলতেই থাকে। মেথঅ্যামফিটামিনের সঙ্গে ক্যাফেইন মিশিয়ে ব্যবহূত হতে থাকে মাদকদ্রব্য হিসেবে। থাইল্যান্ডে এই মাদকটির উৎপাদন হয় সবচেয়ে বেশি। ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশে। গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, পেথেডিনের পথ ধরে বাংলাদেশেও এখন সহজলভ্য হয়ে উঠেছে মাদকটি। অনেকে একে বলে ‘ক্রেজি মেডিসিন’ বা পাগলা ওষুধ। অনেকের কাছে তা নাজি স্পিড বা শুধু স্পিড। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের অনেক এলাকায় এর লেনদেন হয় ‘বাবা’ নামে।
ইয়াবা একটি থাই শব্দ। নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও ধরা হয়, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে ইয়াবার আবির্ভাব ঘটে। পরবর্তী সময়ে ২০০০ সাল থেকে সীমান্তপথে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে চোরাচালান হয়ে তা দেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে। প্রথম দিকে উচ্চমূল্যের কারণে ইয়াবার প্রচলন সীমাবদ্ধ ছিল শুধু উচ্চবিত্ত ব্যক্তিদের মধ্যেই। পরে প্রচণ্ড উত্তেজক ও নেশাকারক এ ট্যাবলেটটির উপকরণ চোরাইপথে এনে দেশের ভেতরেই তা তৈরি করা শুরু হয়। দাম কিছুটা কমতে থাকে। ফলে উচ্চবিত্তের গণ্ডি ছাড়িয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যুবক-যুবতীদের মধ্যেও ইয়াবার বিস্তার ঘটে।
তরুণ-তরুণীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে মূল উপাদানের সঙ্গে মেশানো হয় আঙুর, কমলা বা ভ্যানিলার ফ্লেভার; সবুজ বা লাল-কমলা রং। অধিকাংশ মাদকসেবী ট্যাবলেটটি মুখেই গ্রহণ করে। অনেকে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের ওপর রাখা ট্যাবলেটের অপর প্রান্তে তাপ দিয়ে একে গলিয়ে ফেলে। এরপর সেখান থেকে যে বাষ্প বের হয়, তা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে। আবার ট্যাবলেটটি গুঁড়ো করে, পানিতে মিশিয়ে সিরিঞ্জের মাধ্যমে শিরাপথে সরাসরি রক্তেও ঢুকিয়ে দেয় অনেকে।
ইয়াবা খাওয়ার কোন উপকারিতা আছে
ইয়াবার আনন্দ আর উত্তেজনা আসক্ত ব্যক্তিদের সাময়িকভাবে ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব যন্ত্রণা। তারা বাস করে স্বপ্নের এক জগতে। ইয়াবার প্রচণ্ড উত্তেজক ক্ষমতা আছে বলে যৌন-উত্তেজক হিসেবে অনেকে ব্যবহার করে এটি। ইয়াবা সেবনে প্রথমে যৌন উত্তেজনা বাড়ে, ঘুম ও ক্ষুধা কম হয়। এটার জন্য তারা ইয়াবা সেবনে সহজে উৎসাহিত হয়। কিন্তু এটা সীমিত সময়ের জন্য। ২/১ বছরের মধ্যে তাদের যৌন উত্তেজনা চিরতরে বন্ধ। চিকিৎসা করলেও ভাল হয় না।
ইয়াবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
ইয়াবা একটি ভয়ংকর নেশার উপকরণ। এটা সেবনে যৌবন ও জীবনীশক্তি থাকে না। তাদের দাম্পত্য জীবন চিরতরে পন্ড হয়। এক থেকে দুই বছর-এর মধ্যে ইয়াবা সেবনকারীদের নার্ভগুলো সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়। ইয়াবা সেবনকারীরা মানসিক রোগে ভুগতে থাকে। অস্থির ভাব এবং যেকোন সময়ে যে কোনো অঘটন তারা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। বেশিরভাগ ইয়াবা আসক্ত মানসিক রোগের শিকার হয়। শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, মেজাজ হয় খিটখিটে, গলা-মুখ শুকিয়ে আসতে থাকে অনবরত। প্রচণ্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়তে থাকে। বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। দীর্ঘদিনের আসক্ত ব্যক্তিরা উচ্চরক্তচাপের রোগীই হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের ভেতরকার ছোট রক্তনালিগুলো ক্ষয় হতে থাকে, এগুলো ছিঁড়ে অনেকের রক্তক্ষরণ শুরু হয়। স্মৃতিশক্তি কমে যায়, মানসিক নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, অহেতুক রাগারাগি, ভাঙচুরের প্রবণতা বাড়ে। পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্র বা পারিবারিক জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে। সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা পিছিয়ে পড়তে থাকায় আসক্ত ব্যক্তিরা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়। কারও কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। দৃষ্টিবিভ্রম, শ্রুতিবিভ্রম আর অস্বাভাবিক সন্দেহ প্রভৃতি উপসর্গ থেকে একসময় জটিল মানসিক ব্যাধিও দেখা দেয়। কয়েক ঘণ্টা বা নির্দিষ্ট সময় পর ইয়াবা সেবন না করলে আসক্ত ব্যক্তির শরীরে ও মনে নানা উপসর্গ দেখা দেয়, ফলে নেশাগ্রস্তরা নেশার জগতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
ইয়াবা সেবনকারী চেনার উপায়
প্রকৃতপক্ষে ইয়াবা সেবনকারী ব্যক্তিকে সঠিকভাবে শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই। তবে তাদের কিছু আচরণ দেখে ইয়াবা সেবনকারী অনুমান করা যেতে পারে । ইয়াবা হল মেথামফেটামিন এবং ক্যাফেইনের মিশ্রণ। ওষুধটি একই সঙ্গে মস্তিষ্ক ও হার্টকে আক্রমণ করে। ইয়াবা সেবনের ফলে একজন ব্যক্তির শারীরিক ও আচরণগত পার্থক্য জানুন-
শারীরিক এবং আচরণগত পার্থক্য
- মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
- একজন ইয়াবা ব্যবহারকারীর ঘুম অস্বাভাবিক। তারা বেশ কয়েক রাত একটানা না ঘুমিয়ে থাকতে পারে।
- শারীরিকভাবে খিঁচুনি হয়।
- ক্ষুধা থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে মিষ্টির প্রতি এক ধরনের আসক্তি তৈরি হয়।
- মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটে। অর্থাৎ তারা কখন কী করছে তার কোনো ধারণা নেই।
- স্বাভাবিক স্মৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন।
- মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
- অতিরিক্ত ইয়াবা সেবনের ফলে হাইপারথাইরয়েডিজম বা উচ্চ শারীরিক তাপমাত্রা হতে পারে।
- ইয়াবা সেবনকারীরা প্রায়ই বিষণ্নতায় ভোগেন।
- দীর্ঘ সময় ধরে ইয়াবা সেবনকারী ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে।
- তারা বেশিরভাগ সময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে।
- ইয়াবা একজন শান্ত ব্যক্তিকে হিংস্র এবং আক্রমণাত্মক করে তুলতে পারে।
- ইয়াবা সেবনে হ্যালুসিনেশন এবং সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে।
ইয়াবা যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে কারণ নিয়মিত ইয়াবা সেবনের ফলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, অনিদ্রা, খিঁচুনি, মস্তিষ্ক বিকৃতি, রক্তচাপ বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন, হার্ট অ্যাটাক, ঘুমের ব্যাঘাত, শরীরে কিছু নড়াচড়ার অনুভূতি, অস্বস্তি ইত্যাদি হতে পারে। মানসিক অবস্থা, কিডনি রোগ, স্থায়ী যৌন- অক্ষমতা, ফুসফুসে প্রদাহের পাশাপাশি ফুসফুসের টিউমার ও ক্যান্সার হতে পারে।
ইয়াবা ওষুধ না মাদক
ইয়াবার প্রধান উপাদান মেথামফেটামিন ও ক্যাফেইন। এটি একটি উত্তেজক ওষুধ। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে ADHD-এর কিছু ক্ষেত্রে মেথামফেটামিনের মতো ওষুধ দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু ইয়াবা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার মতো যথেষ্ট বিশুদ্ধ নয় এবং উত্তেজক নেশার ভয়ানক মাত্রা ও স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণে ড্রাগ হিসেবে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত নয়। ইয়াবা সেবন করার সাথে সাথে ইয়াবার রাসায়নিক উপাদানের প্রভাব সারা শরীরে এবং রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে মস্তিষ্কে অনুভূত হয়।
তবে যারা আবার ফিরে পেতে চায় স্বাভাবিক সুস্থ জীবন, তাদের নিরাশ হওয়ার কিছু নেই। এমন নয় যে, আসক্ত ব্যক্তিরা আর কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে না। এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি, আসক্ত ব্যক্তিদের আশার আলো দেখাচ্ছে, তারা ফিরে যেতে পারছে মাদকমুক্ত জীবনধারায়। ওষুধ, সাইকোথেরাপি ও অন্যান্য উপায়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাপন পদ্ধতিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়, পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হয় তার আগের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, যা তাকে মাদকাসক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এতে মানসিক রোগ চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীর যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পরিবার, স্বজন আর প্রকৃত ভালো বন্ধুরও। একজন নেশাসক্ত ব্যক্তি সবার সম্মিলিত সহযোগিতায়ই আবার ফিরে পেতে পারে মাদকমুক্ত সুস্থ জীবন। তবে ইয়াবার আগ্রাসন থেকে দেশের যুবসমাজকে রক্ষা করতে প্রয়োজন সামগ্রিক প্রতিরোধ। পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যেসব পথে দেশে ইয়াবা ঢুকছে, সেসব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। দেশের ভেতর ইয়াবার উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়লে তাঁর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ইয়াবার কুফল সম্পর্কে সবাইকে বিশেষত উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীদের সচেতন করতে হবে।
Comments
Post a Comment