এশিয়ার অন্যতম সেরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি এবং মুসলিম বিশ্বের বিবেক ডা. মাহাথির মোহাম্মদ ছিলেন তার দেশের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল টানা পাঁচটি সংসদীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং সরকার গঠন করে। তিনি এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ৩০ অক্টোবর, ২০০৩ -এ, তিনি স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। 92 বছর বয়সে, দীর্ঘ পনের বছরের অবসরের পর, প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের ব্যাপক দুর্নীতির কারণে মাহাথির মোহাম্মদ রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন। ২০১৮ সালের ৯ মে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার একদিন পর ১০ মে তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
জন্ম
ডাঃ মাহাথির মোহাম্মদ ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের একটি শহর এ্যালোর সেটররে একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার আগে যে তিনজন প্রধানমন্ত্রী মালয়েশিয়া শাসন করেছেন তারা সবাই সমাজের এলিট শ্রেনীর। তবে মাহাথির খুব সাধারণ ঘর থেকে এসেছেন। পিতামাতার নয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তার বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক এবং পরে সরকারি অডিটর হিসেবে কাজ করেন। মাহাথিরের মা সাধারণ গৃহিণী হলেও তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। ছোটকাল থেকেই তিনি মাহাথিরকে বাসায় পবিত্র কোরআন শিক্ষা দিতেন।
মাহাথিরের শিক্ষা জীবন
শৈশবে মাহাথির প্রথমে মালয় এবং তারপর শহরের একমাত্র ইংরেজি স্কুলে শিক্ষা লাভ করেন। তাদের বাড়িতে একজন ধর্মীয় শিক্ষক ছিলেন যিনি প্রতিদিন তাদের বাড়িতে এসে পবিত্র কুরআন, ইসলামে বিশ্বাস এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শেখাতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় 1941 সালে জাপান মালয়েশিয়া আক্রমণ করে। তারা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বন্ধ করে একটি জাপানি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। মাহাথিরের বয়স তখন ষোল। প্রথমে তিনি জাপানি স্কুলে যেতে চাননি। সে সময় মাহাথির স্থানীয় একটি ছোট বাজারে কলা বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু বাবার চাপে পরে সেই জাপানি স্কুলে ভর্তি হন। মালয়েশিয়ায় জাপানি শাসন চলে প্রায় তিন বছর।
১৯৪৭ সালে তিনি সিঙ্গাপুরের King Edward College of মেডিসিন এ যোগদান করেন এবং মেডিসিনে পড়াশোনা শেষ করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়ায় ফিরে আসেন।
পরিবার
সিঙ্গাপুরে পড়ার সময় মাহাথির সিতি হাসমা মোঃ আলীর সাথে দেখা করেন। সিথি হাসমা তখন দ্বিতীয় মালয় মহিলা যিনি সিঙ্গাপুরের একই কলেজে স্কলারশিপে মেডিসিন অধ্যয়ন করেন। পরে মাহাথির ও সিতি হাসমা বিয়ে করেন। তাদের মোট সাতটি সন্তান রয়েছে, যার মধ্যে তিনটি তারা দত্তক নিয়েছে। মাহাথির পরিবার সম্পর্কে বলেন, "প্রত্যেকের নিজের পরিবার একটি নিরাপদ জায়গা - এমন কিছু যা আমাদের জটিল সমাজে স্থিতিশীলতা আনে।"
মাহাথিরের আলোকিত কর্মময় জীবন
মাহাথিরের বর্ণিল রাজনৈতিক জীবন
মাহাথির যখন বিশের কোঠায় তখন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সহপাঠীদের জড়ো করে তিনি গোপনে 'মালয় ইউনিয়ন' প্রস্তাবের বিরোধিতা শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের পরাজয়ের আগে তারা তৎকালীন মালয়েশিয়াকে থাই সরকারের শাসনে তুলে দেয়। পরে ব্রিটিশরা ফিরে এসে 'মালয় ইউনিয়ন' প্রতিষ্ঠা করে। মালয় ইউনিয়ন সত্যিই একটি সম্পূর্ণ উপনিবেশ ছিল। মাহাথির ও তার বন্ধুরা রাতের অন্ধকারে সারা শহরে রাজনৈতিক বার্তা সম্বলিত পোস্টার লাগাতেন। তাদের লক্ষ্য ছিল সীমিত, 'মালয়ান ইউনিয়ন' প্রস্তাবের অবসান ঘটানো এবং প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা। তারা সাইকেলে করে পুরো প্রদেশে ঘুরে বেড়াতেন এবং জনগণকে ব্রিটিশবিরোধী হিসেবে সংগঠিত ও সক্রিয় করতে ব্যস্ত ছিলেন। সংগঠনে, মাহাথির সাধারণত সচিব বা দ্বিতীয় অবস্থান বেছে নেন, কারণ দ্বিতীয় ব্যক্তিকে আরও সাংগঠনিক কাজ করতে হয় এবং অন্যান্য দলের সাথে যোগাযোগ করতে হয়।
মাহাথির প্রথমে কেদাহ মালয় যুব ইউনিয়ন এবং পরে কেদাহ মালয় ইউনিয়ন নামে রাজনৈতিক দলগুলিকে সংগঠিত করেছিলেন, যা পরবর্তীতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা ইউএমএনওতে পরিণত হয়।
সিঙ্গাপুরে মাহাথির
সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন মাহাথির সেখানকার কলেজের মালয় ছাত্রদের নিয়ে 'মালয় স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন' গঠন করেন। তবে এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান ও ফলাফলের উন্নয়ন। এর কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না।
মাহাথিরের জাতীয় রাজনীতি
সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেননি। নিজস্ব ক্লিনিক খোলার পর জাতীয় রাজনীতিতে তার সম্পৃক্ততা বেড়ে যায়। তিনি UMNO-এর প্রাদেশিক শাখার একটি সিনিয়র পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে ৩৯ বছর বয়সে, মাহাথির প্রথম সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। তবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সহায়তায় তিনি ডাক্তারি চর্চা চালিয়ে যান। তিনি ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই পেশা ধরে রেখেছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রার্থী হন। ওই বছরই ইউএমএনও’র নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। UMNO একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে পারেনি। কোনো কোনো প্রদেশে তারা সরকার গঠনও করতে পারেনি। ১৯৬৯ সালের ৩০শে মে কুয়ালালামপুরে চীনা ও মালয়দের মধ্যে ব্যাপক দাঙ্গা শুরু হলে রাজনৈতিক সংকট চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। দাঙ্গার জন্য ইউএমএনও নেতৃত্বকে দায়ী করে, মাহাথির প্রধানমন্ত্রী টুঙ্কু আবদুর রহমানকে একটি কড়া শব্দে চিঠি লেখেন এবং তার পদত্যাগের পরামর্শ দেন। দলের নেতারা এই সমালোচনা সহ্য না করে মাহাথিরকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। পরের তিন বছর তিনি নিজ দেশের রাজনীতি থেকে নির্বাসনে ছিলেন। 1972 সালে, মাহাথির আবার পার্টির সদস্য এবং সিনেটর হিসাবে পুনর্বহাল হন।
মাহাথিরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহণ
১৯৭৪ সালের নির্বাচনে দল জয়ী হলে তাকে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাত্র দুই বছর পর, মাহাথির 1976 সালে উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তিনি এতে সফল হন। উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের জন্য অনেক কিছু করার পরিকল্পনা মাহাথিরের থাকলেও তিনি স্বাধীনভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হননি। 1981 সালের 16 জুলাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, তিনি তার সমস্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিলেন। মাহাথির মোহাম্মদ টানা ২২ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রতিবারই তিনি ও তার দল নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছেন। মাহাথির মোহাম্মদ এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। 2003 ওআইসি সম্মেলনের সফল সমাপ্তির পর, তিনি 30 অক্টোবর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।
২০১৮ সালের ৯ মে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে জয়ের পরদিন ১০ মে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তিনি। ১৫ বছর পর আবার দেশটির কাণ্ডারির ভূমিকায় দেখা যাবে ৯২ বছর বয়সী এই রাজনীতিককে। প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক নির্বাচিত নেতা হিসেবে ইতিহাস গড়লেন মাহাথির মোহাম্মদ। এর আগে টানা প্রায় ২২ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে তিনি ক্ষমতা থেকে সরে যান। বুধবার অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের রাজনৈতিক জোট বারিসান ন্যাশনালকে (বিএন) হারিয়ে মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। আনুষ্ঠানিক ফলাফলে জানা গেছে, মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট পাকাতান হারাপান পার্লামেন্টের ১১৩টি আসনে জয়ী হয়েছে। পার্লামেন্টের মোট আসন ২২২টি। অন্যদিকে বারিসান ন্যাশনাল জিতেছে ৭৯টি আসনে। মাহাথির মোহাম্মদ নিজেও একসময় বারিসান ন্যাশনাল জোটের অংশ ছিলেন। তবে ১৫ বছর পর রাজনীতির মঞ্চে ফিরেই নিজের দল ও একসময়ের শিষ্য নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে দাঁড়ান তিনি। মাহাথির বলেছিলেন, যে রাজনৈতিক দল দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়, সেই দলে থাকা লজ্জার। বিরোধীদলীয় জোট পাকাতান হারাপান ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে। তখন মাহাথির বলেছিলেন, নির্বাচিত হলে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকবেন না তিনি। আনোয়ার ইব্রাহিমকে ক্ষমতায় এনেই বিদায় নেবেন।
মেধাবী ছাত্র হিসেবে মাহাথির
মেধাবী ছাত্র হিসেবে মাহাথিরের পছন্দের বিষয় ছিল আইনবিদ্যা; কিন্তু সরকার তাকে পরামর্শ দেয় ডাক্তার হওয়ার। তাই তিনি সিঙ্গাপুরের কিং এডওয়ার্ড সেভেন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। স্কুলে এবং মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় তিনি একটি ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন এবং পত্রিকায় লিখতেন। উল্লেখ্য, মেধাবী ছাত্র মাহাথির খুব সহজেই বৃত্তি পেয়ে যান। এখানে উল্লেখ করার মতো আরও একটি বিষয় রয়েছে। সেটি হচ্ছে ১৯৪৭ সালে সিঙ্গাপুরের মেডিকেল কলেজে মাহাথিরসহ মাত্র সাতজন মালয় শিক্ষার্থী ছিলেন। পরবর্তীতে এক সময় মেধাবী মাহাথির পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসেন নিজ দেশ মালয়েশিয়ায়। ফিরে আসার পরই আসলে নিজের জীবনের বাঁক পরিবর্তন করেন তিনি। দেশ ও জাতির জন্য নতুন কিছু করার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেন।
আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার
যে গল্পের হিরো ডা. মাহাথির মোহাম্মদ, সেই গল্পের শুরুটা কিন্তু অন্য আট-দশটি দুনিয়া পাল্টানো গল্পের মতোই সাদামাটা। বদলে ফেলার জন্য চাই জীর্ণশীর্ণ একটা অবয়ব। সেই অবয়বকে আমূল পাল্টে ফেলাটাই একজন শিল্পী কিংবা স্বপ্নদ্রষ্টার কাজ। মাহাথির সেই স্বপ্নদ্রষ্টা। আর মাহাথিরের স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু আজকের আধুনিক মালয়েশিয়া। কিন্তু আলো ঝলমলে যে আধুনিক মালয়েশিয়া আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, সেই চোখ ধাঁধানো কী আগে থেকেই ছিল? ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। এই মালয়েশিয়া আসলে রূপকথার সফল বাস্তবায়নেরই প্রতিচ্ছবি।
মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ সালে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দল পর পর পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। তিনি এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এক সময়ের অনুন্নত মালয়েশিয়াকে উন্নত বিশ্বের তালিকায় এনেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। এশিয়ার এই নন্দিত নেতা বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের গণতান্ত্রিক এ প্রধানমন্ত্রী ২০০৩ সালের ৩০ অক্টোবর স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। ততদিনে মালয়েশিয়ার চেহারাও পাল্টে যায়। কোন ম্যাজিকে এটা সম্ভব জানতে চাইলে সাক্ষাৎকারে মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, কোনো ম্যাজিক বা ফর্মুলা নয়, মালয়েশিয়ার মানুষের সমন্বিত চেষ্টায় আজ এ অবস্থান সম্ভব হয়েছে।
রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর মাহাথিরের আগ্রহ ছিল সুগভীর। তাই একটি জাতির উন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়। সরকারি নীতি এবং বেসরকারি বিনিয়োগের মাঝে তিনি একটি সমঝোতা এবং সখ্য গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। সরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর বেসরকারিকরণ মালয়েশিয়ার দ্রুত শিল্পায়নে সহায়ক হয়েছে। তিনি সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ আর সহযোগিতায় বেসরকারি খাতকে লাভজনক করতে মালয়েশিয়ান বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করেছেন।
সবচেয়ে ব্যতিক্রমী প্রধানমন্ত্রী
ডা. মাহাথির মোহাম্মদকে কেবল সফল বললেই চলবে না। তিনি নীতি ও আদর্শে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী প্রধানমন্ত্রী বলতেই হবে। মাহাথির নিজের নাম লেখা ব্যাজ পরতেন। আধুনিক মালয়েশিয়ার বাস্তবায়নে দেশেই গাড়ি তৈরি ও বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়াতে নিউ ইকোনমিক পলিসি সফলভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। এনইপির উদ্দেশ্য ছিল জাতি নির্বিশেষে দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নতুন সম্পদ সৃষ্টি করা। ২০ বছর মেয়াদি এনইপি শেষ হওয়ার পর ১০ বছর মেয়াদি ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট পলিসি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার আমলে নিজের নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামকরণ একদমই নিষিদ্ধ ছিল।
মাহাথিরের শাসনে উন্নয়ন
তার প্রতিভা, প্রজ্ঞা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে বদলে গেছে মালয়েশিয়া। তাই তাকে আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক বলা হয়।
- ক্ষমতায় এসে একের পর এক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি মালয়েশিয়ার সকল মুসলমানের জন্য ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন।
- মালয়েশিয়ার ৯৫ শতাংশ শিক্ষা খরচ সরকার বহন করে। মাহাথিরের আমল থেকেই এই নীতি চালু হয়েছে। তিনি আশির দশকে গৃহীত জাতীয় উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন শুরু করেন। ফলস্বরূপ, ১৯৯২ সালে মালয়েশিয়া তার নিজস্ব নাগরিকদের সবাইকে কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা করে আরও ৮ লাখ বিদেশি শ্রমিক নিয়োগ দেয়।
- একই বছরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত একাই $৬.৫ বিলিয়ন মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে।
- পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নির্মাণ, সমুদ্র থেকে ৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমি উদ্ধার, আধুনিক বিমানবন্দর নির্মাণ, একাধিক শিল্প পার্ক, মহাসড়ক নির্মাণ সফল হয়েছে।
- ১৯৯০ সালে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ অতিক্রম করে।
- ১৯৮২ সালে মালয়েশিয়ার জিডিপি ছিল ২৭.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০০২ সালে ৯৫.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। তিনি মালয়েশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশের তালিকার নীচে থেকে ১৪তম স্থানে নিয়ে এসেছেন।
- মাহাথির একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। কর্মীদের উদ্দেশে যা যা বলতেন , তা তিনি নিজেই করে দেখিয়েছেন। তিনি সময়মতো অফিসে আসতেন যাতে সরকারি কর্মীরা সময়মতো অফিসে আসেন। টাইম ম্যাগাজিন একবার টানা পাঁচ দিন মাহাথিরের অফিসে প্রবেশের সময় রেকর্ড করেছিল। সেই রেকর্ড অনুযায়ী তার অফিসে প্রবেশের সময় ছিল ৭:৫৭, ৭:৫৬, ৭:৫৭, ৭:৫৯, ৭:৫৭ মিনিটে।
ধর্মীয় চেতনায় ভাস্বর
মাহাথির মোহাম্মদ ইসলামের একনিষ্ঠ অনুসারী। তার পরিবার তাকে ইসলামের ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখার শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু এতে কোনো রূপ গোঁড়ামি ছিল না। ইসলাম সম্পর্কে ‘এ নিউ ডিল ফর এশিয়া’ শীর্ষক নিজের বইতে মাহাথির বলেন, ‘ইসলাম ধর্ম আমাদের জীবনের অংশ। একে পরিত্যাগ করার কোনো কারণ নেই। সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হলে ধর্ম কখনই অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য বাধা হতে পারে না। ইসলামের শিক্ষা সমসাময়িক সময়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিতে হবে। ইসলাম শুধু সপ্তম শতাব্দীর ধর্ম নয়। ইসলাম অবশ্যই সর্বকালের ধর্ম।’ ফলে সাধারণ মানুষের মনে মাহাথিরের জন্য বরাবরই আলাদা জায়গা ছিল।
উপসংহার
মাহাথিরের রাষ্ট্র পরিচালনা ও উন্নয়নের মন্ত্র শুধু তার নিজের দেশেই নয়, সারা বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। "আমাকে ১০ জন যুবক দাও, আমি মালয়ীদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্বজয় করে ফেলব' - এমন আদর্শবাদী চেতনা দিয়ে তিনি দারিদ্র্যের তলানিতে থাকা মালয়েশিয়াকে উন্নয়ন ও আধুনিকতার শীর্ষে নিয়ে এসেছিলেন।
দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ডা. মাহাথির মোহাম্মদ আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর তাবত শাসকদের জন্য একটি অনুকরণীয় আদর্শ। মাহাথির মোহাম্মদের নাম মালয়েশিয়া ও বিশ্ব রাজনীতিতে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে
Comments
Post a Comment