Skip to main content

আরাকান ও রোহিঙ্গা মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত (পর্ব - ১)

আরাকান ও  রোহিঙ্গা মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত। বার্মা ছিল ব্রিটিশ ভারতের বৃহত্তম প্রদেশ। ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল ব্রিটিশ-ভারত সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আর একটি দেশে পরিণত করা হয় বার্মাকে। বার্মা ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়।

আরো পড়ুন: আরাকান ও রোহিঙ্গা মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত (পর্ব - ২)

বর্তমান মিয়ানমারের সাবেক নাম বার্মা। অনুরূপ বর্তমান রাখাইন প্রদেশের সাবেক নাম আরাকান।মিয়ানমারের সামরিক শাসক নে উইন ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের নাম পরিবর্তন করে ‘রাখাইন স্টেট’ নামকরণ করেন। একসময় চট্রগ্রাম ছিল আরাকানের অধীনে। ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খান এক নৌযুদ্ধে আরাকান রাজকে পরাজিত করে চট্টগ্রাম দখল করে নেন এবং চট্রগ্রামকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। 

একদা আরাকান একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। বিভিন্ন সময়ে আরাকান স্বাধীন রাজ্য হিসেবে হিন্দু, মুসলিম ও বৌদ্ধদের মাধ্যমে শাসিত হয়েছে। এখন এটি মায়ানমারের একটি প্রদেশ। বার্মার ১৪টি প্রদেশের মধ্যে একমাত্র আরাকানই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ। আরাকান নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশ থেকে এবং মূল ভূখণ্ড মিয়ানমার থেকে পাহাড় দিয়ে বিচ্ছিন্ন।

আরাকান নামকরণ প্রমাণ করে মুসলিম ঐতিহ্যের কথা। কারণ ইসলামের পাঁচটি মূল ভিত্তিকে একত্রে বলা হয় আরকান। আর এই আরকান থেকেই তার অনুসারী মুসলমানদের আবাস ভূমির নামকরণ করা হয়েছে আরাকান।

রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। রাখাইন রাজ্যটি মিয়ানমারের পশ্চিমে অবস্থিত। রাখাইন বা আরাকানের উত্তরভাগের জনগণ কথা বলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলা ভাষায়। আরাকানের বৌদ্ধরাও এই ভাষা বোঝেন এবং কথা বলেন।

ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকান বলতে বোঝাত বার্মার একটি বিভাগকে। এই বিভাগে ছিল চারটি জেলা। এগুলো হলো : ১. পার্বত্য আরাকান (Arakan Hill Tracts), ২. আকিয়াব (Akyab), ৩. সান্ডোয়ে (Sandoway) এবং ৪. কাউকপিউ (KyaukPyw)। পার্বত্য আরাকান জেলাকে এখন সাবেক আরাকান বিভাগ থেকে পৃথক করে জুড়ে দেয়া হয়েছে বার্মার আর একটি স্বায়ত্তশাসিত অঙ্গরাষ্ট্র চীন (Chin State) রাজ্যের সঙ্গে। চীন মানে চীন দেশ নয়, এই চীন হলো বার্মার একটি প্রদেশ। এখানে বাস করে একাধিক উপজাতি। যার মধ্যে প্রধান হলো চীন। বার্মার এই অঙ্গরাজ্যের (চীনের) সঙ্গে লাগোয়া হলো বাংলাদেশের বান্দরবান এবং কক্সবাজার জেলা। ব্রিটিশ শাসনামলে আরাকানের আয়তন ছিল ২০ হাজার বর্গমাইল। বর্তমানে আরাকানের আয়তন ১৪২০০ বর্গমাইল।

বেসরকারি হিসাব মতে, আরাকানের লোকসংখ্যা ৫০ লক্ষাধিক এবং প্রদেশটিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন আর ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের কারণে এখানকার সিংহভাগ রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এ প্রদেশটিতে রাখাইন ও রোহিঙ্গা ছাড়াও দুই লক্ষাধিক চাকমা, কামাইস ও বর্মি নাগরিক রয়েছে। বার্মার ৭০ লাখ মুসলমানদের বিরাট অংশ আরাকানের অধিবাসী।

রাখাইন হলো পাঁচটি জেলায় বিভক্ত। এগুলো হলো: ১. সিত্তুই। আগে এর নাম ছিল আকিয়াব। সিত্তুই একটি শহরেরও নাম, যা হলো বর্তমান আরাকানের প্রধান সমুদ্রবন্দর। এখানে স্থাপিত হয়েছে আরাকানের সবচেয়ে বড় সমরঘাঁটি। ২. ম্রাউক-উ, যা সম্প্রতি সিত্তুই জেলা থেকে পৃথক করে গঠন করা হয়েছে। ৩ মংডু। ৪. কাউকপিউ। ৫. থানদু।

আরাকানে বেশকয়েকটি উল্লেখযোগ্য নদী আছে যথা: নাফ (Naf), মায়ু (Mayu), কালাদান (Kaladan), লেমব্রু Lembru), অনন (Ann), তনগু(Tangup), স্যান্ডোয়ে (Sandoway) প্রভৃতি। এর মধ্যে কালাদান, নাফ, লেমব্রু ও মায়ু আরাকানের প্রধান প্ৰধান নদী । নাফ নদী প্রস্থে ছোট মনে হলেও বেশ খরস্রোতা। এটি বাংলাদেশ ও আরাকানের মধ্যকার আন্তর্জাতিক সীমারেখা হিসেবে কাজ করে। নাফ নদীর পূর্বতীরে আরাকানের মংডু শহর এবং পশ্চিম তীরে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলা। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ মাইল এবং প্রস্থ ১ থেকে ১.৫ মাইল। নাফ নদীর সম্মুখভাগে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্ৰ জিনজিরা বা সেন্টমাটিন। এখানকার অধিবাসীদের অধিকাংশই আরাকানের হবিপাড়া থেকে এসে এ এলাকায় বসতি স্থাপন করেছে।

কালাদান (Kaladan) আরাকানের সবচেয়ে বড় ও প্রধান নদী। এটি ইয়াহু’ (Yahaw) স্টেটের চিন পাহাড় থেকে বইনু (Bolinu) নামে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণের পার্বত্য আরাকানে প্রবেশের পর কালাদান নাম ধারণ করেছে। সবশেষে এটি আকিয়াব বন্দরের কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে।

বর্মীভাষায় Kala শব্দের অর্থ বিদেশী, Dan শব্দের দ্বারা স্থান অর্থাৎ কালান্দান বলতে বিদেশীদের স্থান বুঝানো হয়ে থাকে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সপ্তদশ শতক থেকে আরাকানীরা পর্তুগীজ জলদস্যুদের সহযোগিতায় দক্ষিণ ও পূর্ববাংলার নদী এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহ থেকে মানুষ অপহরণ করে নাফ নদীর তীর থেকে কালাদান নদীর উত্তর তীরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে তাদেরকে ধান উৎপাদনের জন্য ভূমিদাস রূপে নিযুক্ত করেছিল। তাই এ নদীর নাম কালাদান হয়েছে।

ইসলাম ও আরাকান- আরাকান ও  রোহিঙ্গা মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত 

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্মের বহু পূর্ব থেকে আরব বণিকগণ সমুদ্র পথে আবিসিনিয়া এবং অপরদিকে সুদূর প্রাচ্য চীন পর্যন্ত তাদের ব্যবসার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেছিল। আরব থেকে সুদূর চীনের মাঝপথে তাদের কয়েকটি ঘাঁটিও ছিল। এ পথে তাদের প্রথম ঘাঁটি ছিল মালাবার(মাদ্রাজ, ভারত)। মালাবার উপদ্বীপটি মাদ্রাজের সমুদ্রতীরবর্তী একটি জেলা। আরব বণিকরা বাংলাদেশের চট্রগ্রাম এবং সিলেট, কামরূপ (আসাম, ভারত), রোসাং বা আরাকান (মায়ানমার) এবং চীন দেশে ব্যবসায় করতেন। আরব বণিকদের রুট ছিল দুটি, একটি হলো, মালাবার-চট্রগ্রাম-সিলেট-কামরূপ-চীন।অন্যটি মালাবার-চট্রগ্রাম-রোসাং বা আরাকান-কুনমিং(চীন)।এটাও এক ঐতিহাসিক সত্য যে, সপ্তম-নবম শতক পর্যন্ত এশিয়া ও আফ্রিকায় ইসলামের বাণী প্রচারিত হয়েছিল আরব বণিকদের দ্বারাই।

ইতিহাস থেকে জানা যায় ৬১৫ থেকে ৬২৫ খৃঃ মধ্যে কোনো এক সময় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নির্দেশে তাঁর মামা হযরত সা’য়াদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং তাঁর সাথে কতিপয় সাহাবা চীনে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন। চীন যাবার পথ হিসেবে হযরত সা’য়াদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) চট্টগ্রাম-রোসাং বা আরাকান-চীনের কুনমিং এর পথ বেছে নেন।

হযরত সা’য়দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) চট্টগ্রামে আসেন এবং ইসলাম প্রচার করেন। তাঁর কিছু সাহাবা বাংলাদেশে থেকে যান এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য ছড়িয়ে পড়েন। বাকি সঙ্গীদের নিয়ে হযরত সা’য়াদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) চীনের পথে মিয়ানমারের রোসাং বা আরাকানে আসেন। রোসাং বা আরাকানের আদি বাসিন্দাদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করেন। এই রোসাং-এ হযরত সা’য়াদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ)-র কিছু সাথী ইসলামের খেদমতের জন্য থেকে যান। এই রোসাং বা আরাকানের আদি বাসিন্দারাই বর্তমানের রোহিঙ্গা, যার নামের উৎপত্তি হয়েছে রোসাং থেকে।

এরপর হযরত সা’য়দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) আরাকান থেকে চীনের কুনমিং-এ যান। ওমর ইবনে আবদুল আজিজের (রহ.) শাসনামলে আরাকানের শাসকদের সঙ্গে আরবীয় মুসলমানদের যোগাযোগের বিষয়টিও প্রমাণিত। তবে দশম ও একাদশ শতাব্দীতে আরব বণিক ও সুফি-সাধকদের ব্যাপক আগমনের ফলে আরাকান অঞ্চলে দ্রুত ইসলামের প্রচার হতে থাকে। তাই বলা যায়, মিয়ানমারে মুসলমানদের ইতিহাস প্রায় ১২০০ বছরের পুরনো।

রোহিঙ্গা কারা? আরাকান ও  রোহিঙ্গা মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত 

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় এক হাজার বছর ধরে রোহিঙ্গারা আরাকানে বসবাস করে আসছে। রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাজ্য ছিল, তখন বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল আরাকানের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। কখনো কখনো অন্য ধর্মের রাজারা সিংহাসনে বসলেও সেনাবাহিনীসহ পুরো প্রশাসন ছিল মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে।

ইতিহাসবিদদের মতে, আরবি শব্দ ‘রহম’ (দয়া করা) থেকে রোহিঙ্গা শব্দের উদ্ভব। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আরবের বাণিজ্য জাহাজ আরাকানের রামব্রি দ্বীপের তীরে এক সংঘর্ষে ভেঙে পড়ে। জাহাজের আরবীয় মুসলমানরা ভাসতে ভাসতে কূলে ভিড়লে ‘রহম’ ‘রহম’ ধ্বনি দিয়ে স্থানীয় জনগণের সাহায্য কামনা করতে থাকে। রহম শব্দই বিকৃত হয়ে রোহিঙ্গা হয়েছে।

সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব। পরবর্তী সময়ে রাখাইন, আরাকানি, বার্মিজ, বাঙালি, ভারতীয়, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের মিশ্রণে এই জাতি ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

‘রোহিঙ্গা’ নামটার একটু বিশেষ ইতিহাস আছে। গত সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা মেং সোআ-মউন-এর সাথে বার্মার আভার রাজার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মেং সোআ-মউন পালিয়ে আসেন গৌড়ের সুলতান জালাল-উদ-দীন মুহাম্মদ শাহর কাছে। জালাল-উদ-দীন তাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন যুদ্ধ জয় করে তার হৃত রাষ্ট্র পুনরুদ্ধার করার জন্য। কিন্তু ওই সেনাবাহিনীর অধিনায়ক তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ফলে তিনি যুদ্ধে হেরে বন্দী হন আভার রাজার হাতে। তবে তিনি অনেক কষ্টে বন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে আবার গৌড়ে আসতে সক্ষম হন। গৌড়ের সুলতান এবার তাকে আরো সৈন্য প্রদান করেন। ওই বাহিনী পরিচালনার জন্য প্রদান করেন একজন খুবই দক্ষ সেনাপতি।

মেং সোআ-মউন এবার আভার রাজাকে পরাজিত করে তার হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন। তিনি আরাকান রাজ্যে একটি নতুন রাজধানী শহর গড়েন, যার নাম দেন রোহং। গৌড় থেকে যাওয়া মুসলমান সৈন্যরা মেং সোআ-মউনর অনুরোধে থেকে যান রোহং শহরে। সৈন্যরা বিবাহ করেছিলেন স্থানীয় কন্যাদের। এদের বংশধরদের বলা হতে থাকে রোহিঙ্গা মুসলমান। রোহিঙ্গারা জোর করে আরাকানে যাননি। বর্তমান রোহিঙ্গারা রোহং শহরে গৌড় থেকে যাওয়া মুসলমান সৈন্যদের বংশধর।

ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ গিয়েছে আরাকানে। তখন এই ক্ষেত্রে কোনো বাধাই ছিল না। চট্টগ্রাম থেকে সহজেই গিয়েছে আরাকানে। তারা আরাকানে ক্ষেত-খামার করেছে। আরাকানের অর্থনীতিকে করেছে সমৃদ্ধ। বার্মা ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়। এর পরে অবাধে আসা-যাওয়া বন্ধ হয়।

গৌড়ের সুলতান জালাল-উদ-দীনের জীবন খুবই বিচিত্র। ইনি ছিলেন রাজা গণেশের পুত্র। তার আদি নাম ছিল যদু। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং জালাল-উদ-দীন নাম ধারণ করে গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইনি গৌড়ের সিংহাসনে দুইবার আরোহণ করেন। তার দ্বিতীয়বার রাজত্বকালে (১৪১৪-১৪২৩ খ্রি.) মেং সোআ-মউন আসেন গৌড়ে। রাজা গণেশ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। সাধারণভাবে বলা হয়, তিনি ছিলেন বর্তমান রাজশাহী অঞ্চলের ভাতুরিয়ার একজন ক্ষমতাশালী সামন্ত। তিনি গৌড়ের সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু তার পুত্র যদু ইসলাম গ্রহণ করে জালাল-উদ-দীন নাম ধারণ করেন। গড়ে তোলেন এক বিরাট সাম্রাজ্য, যা ছিল চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। আরাকানের রাজা তাই সহজেই পালিয়ে এসে আশ্রয় পেতে পেরেছিলেন তার কাছে। জালাল-উদ-দীন খুব ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন।

তার সময়ে বহু সম্ভ্রান্ত হিন্দু ইসলাম গ্রহণ করেন। হতে পারে আরাকানের রাজাও তার কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। কেননা, মেং সোআ-মউন যে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন তার বহু রাজারই থাকতে দেখা যায় দু’টি করে নাম। একটি নাম আরাকানি, আর একটি নাম গৌড়ের সুলতানদের মতো আরবি-ফারসি। আরাকানের এসব রাজা সিংহাসনে আরোহণের সময় মুসলিম নাম গ্রহণ করতেন।

আরাকানের শেষ রাজা, যার মুসলিম নাম থাকতে দেখা যায়, তার আরাকানি নাম হলো মিন-থামা-উংলা। আর মুসলিম নাম হলো হুসেন শাহ্ (১৬১২-১৬২২ খ্রি.)। এসব আরাকানি রাজার মুদ্রা পাওয়া গেছে। মুদ্রার একপিঠে আরবি-ফারসি অক্ষরে লেখা থাকতে দেখা যায় তাদের মুসলিম নাম। এমনকি এদের মধ্যে তিনজন রাজার মুদ্রার ওপর কালেমায়ে ত্যইয়িবা লেখা থাকতে দেখা যায়। এসব মুদ্রা রক্ষিত আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে।

রোহিঙ্গা এবং জেনারেল অং সান - আরাকান ও  রোহিঙ্গা মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত 

অং সান সুচির বাবা জেনারেল অং সানের অন্যতম রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন একজন রোহিঙ্গা, তাঁর নাম আবদুর রাজ্জাক। আবদুর রাজ্জাক বার্মা মুসলীম লীগের সভাপতি ছিলেন এবং মিয়ানমারের সংবিধানের খসড়া প্রণয়নকারী। আবদুর রাজ্জাক ছিলেন জেনারেল অং সানের গঠিত বার্মার স্বাধীনতা পূর্ববর্তী অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রী সভার শিক্ষা ও পরিকল্পনামন্ত্রী। কেবল আবদুর রাজ্জাকই নন, সুচির বাবা জেনারেল অং সানের সবচেয়ে ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহযোগীদের মধ্যে আরও অনেক মুসলমান ছিলেন।

বার্মার ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে, জেনারেল অং সান-এর নেতৃত্বে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন করে বার্মা স্বাধীন করে। বার্মার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ছিলো মুসলমানদের অসামান্য অবদান। তবে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হায়াং এবং গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চি উভয়েই জাতিগত বিদ্বেষ প্রকাশ করে বার্মার রাজনৈতিক ইতিহাসকে অস্বীকার করেছেন।

১৯৪৭ সালের ১৯ জুলাই বার্মার জাতির পিতা জেনারেল অং সানের সাথে যে ছয়জন মন্ত্রী খুন হন তাদের মধ্যে আবদুর রাজ্জাক অন্যতম। বার্মা আজও রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৯ জুলাইকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।

মগের মুলুক-এর উৎপত্তি - আরাকান ও  রোহিঙ্গা মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত 

‘মগের মুলুক’ বাংলাদেশে একটি সুপরিচিত বাগধারা। মগের মুলুক বলতে বোঝায় জোর যার মুলুক তার। এ বাগধারা মিয়ানমারের মগদের বর্বরতা ও দস্যুপনা থেকেই এসেছে। বর্তমানে যারা রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর আক্রমণ করছে, তাদের বলা হচ্ছে রাখাইন উপজাতি। এ রাখাইন উপজাতির আগের নাম মগ। মগরা ঐতিহাসিকভাবেই বর্বর, নিষ্ঠুর, অসভ্য। হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, মানুষের গলায় দড়ি বাঁধা রাখাইন বা মগদের পুরনো অভ্যাস।

সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমাংশে বাংলা বা বঙ্গদেশ খুব সমৃদ্ধ ছিল। ধন-সম্পদে ভরপুর ছিল তখনকার বাংলা।ওই সময় পর্তুগিজ বা ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের সঙ্গে আরাকানি মগ দস্যুরা হাত মিলিয়ে বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় এলাকায় লুটপাট, ডাকাতি ও ধর্ষণ করত, সুন্দরী নারীদের অপহন করতো, তখন থেকেই ‘মগের মুলুক’ বাগধারার উৎপত্তি হয়।

‘ইস্ট ইন্ডিয়া ক্রোনিকলস’-এর বর্ণনায় জানা যায়, ১৭১৮ সালে বার্মার রাখাইন রাজা দক্ষিণবঙ্গ আক্রমন করে তছনছ করে অন্তত এক হাজার ৮০০ জন সাধারণ অধিবাসীকে ধরে নিয়ে যান। বন্দীদের রাজার সামনে আনা হলে রাখাইন রাজা তাদের একদলকে নিজের দাস হিসেবে বেছে নেন এবং বাকিদের গলায় দড়ি বেঁধে বাজারে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেন।

বৌদ্ধ মগদের সাম্প্রতিক গণহত্যা তাদের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে।

রোহিঙ্গা নির্যাতন - আরাকান ও  রোহিঙ্গা মুসলমান : সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত 

দশকের পর দশক মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় উগ্র বৌদ্ধরা আরাকানের মুসলমানদের উপর চাপাতি ও অস্ত্র হাতে বর্বর হামলা চালিয়েছে। পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ, পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে নারীদের। সেনাবাহিনীর ধর্ষনের ভয়ে নারীরা প্রায় বারোমাস গর্ভধারণ করতেন।

২৫ আগস্ট-২০১৭ থেকে সেখানে সেনাবাহিনী পুরোদমে নৃশংস অভিযান শুরু করেছে বিপর্যস্ত ও নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের ওপর। এত বড় নিষ্ঠুর, নির্মম গণহত্যা এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা বর্তমান পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি দেখা যায় না।আরাকানে বেশ কয়েকটি জাতি-গোষ্ঠীর লোক বাস করে, তবে রোহিঙ্গাদের এককভাবে বেছে নেয়া হয়েছে একটি কারণে, তা হলো তারা মুসলিম।

আজ মিয়ানমার সরকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের জন্য যে নৃশংসভাবে হত্যাসহ নিগৃহীত ও উৎপীড়ন করছে তা ইতিহাসে বিরল। বর্তমান বিশ্বে রোহিঙ্গারাই হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে সংখ্যাগুরুদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিগৃহীত সম্প্রদায়।

জাতিসঙ্ঘ বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের উল্লেখ করেছে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেস মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। রোহিঙ্গাদের এই দুর্দশাকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম সময়ের শরণার্থী সঙ্কট, মানবিক সঙ্কট ও মানবাধিকারের জন্য এক দুঃস্বপ্ন বলে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব আখ্যায়িত করেছেন।

আরাকানে রোহিঙ্গাদের উপর যে ভয়াবহ নির্যাতন হয়েছে তা আমরা পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কিছু ভিডিও ক্লিপ থেকে দেখেছি রোহিঙ্গাদের উপর ঘটে যাওয়া ইতিহাসের নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়নের চিত্র। কিছু কিছু ভিডিওতে দেখেছি কতটা নির্মম ভাবে রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হয়েছে, কেটে নিয়েছে মাথা, মুসলিম তরুণীদের উপরে হিংস্র জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীরকে খাবলে খাবলে খেয়েছে বার্মিজ শকুনেরা। জানোয়ারদের ধর্ষনের হাত থেকে রেহাই পায়নি ৮ বছরের বাচ্চা মেয়েও। শরীরের বিভিন্ন অংশে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শাহাদাত করেছে আমাদের মুসলিম ভাইবোনদের।

পরিকল্পিতভাবে মুসলিম বুদ্ধিজীবী, গ্রামপ্রধান, আলেম-ওলামা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, আর সেখানে মগদের জন্য বসতি নির্মাণ করা হয়।

শতাব্দীকাল ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর চলা নির্মম নির্যাতনের বিষয়টি এখন গোটা বিশ্বের সামনে পরিষ্কার। এটাও স্পষ্ট যে শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই তাদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের কারণ

বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন (আরাকান) রাজ্য মিয়ানমারের দরিদ্র রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি। এ রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেশটির সরকার রোহিঙ্গাদের বরাবরই নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। আর সময় সুযোগ বুঝে নানা অজুহাতে তাদের করছে বিতাড়ন। তবে মূল বিষয় আড়ালে রেখে দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, ‘রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী। রোহিঙ্গারা অবৈধ বাঙ্গালী অভিবাসী।তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের উৎখাতের ঘটনা নতুন নয়। অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলছে এই উৎখাত অভিযান। যে কারণে মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিতাড়ন করছে, তা নিম্নে প্রদত্ত হলো-

১। স্বাধীন আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠা

প্রায় একশত বছর আগ থেকে রোহিঙ্গারা আরাকানের স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করছে।কারণ এক সময় আরাকান ছিলো স্বাধীন মুসলিম রাজ্য। স্বাধীন রাজ্য হিসেবে মুসলিম শাসকদের মাধ্যমে আরাকান শাসিত হয়েছে।

ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৭ সালে বার্মা প্রদেশকে ব্রিটিশ-ভারত থেকে পৃথক করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আলাদা রাজ্যের মর্যাদা দেয়।বার্মাকে ভারতবর্ষ হতে পৃথক করার পর রোহিঙ্গারা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এজন্যে ১৯৩৮ সালে আরাকানে বৌদ্ধ-মুসলিম মারাত্মক দাঙ্গা হয় এবং সে দাঙ্গায় বহু মুসলিম হতাহত হয়। এভাবে বারবার রোহিঙ্গা মুসলিমরা স্বাধীন আরাকানের জন্যে সংগ্রাম করে জীবন উৎসর্গ করে।

আরাকান মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন হোক, এটা মিয়ানমার সরকার চায় না।তাই স্বাধীন আরাকান রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে চুরমার করতে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন করছে এবং তাদেরকে বিতাড়ন করছে।

২। মুসলিমবিদ্বেষী এক উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং তার সংঘ

মিয়ানমারে যা হচ্ছে, তা এককথায় জাতিগত বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক হামলা। এর নেপথ্যে এক ব্যক্তির নাম বারবার উঠে আসছে। তাঁর নাম আশ্বিন উইরথুকে। তিনি বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের মনে ভীতি ছড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করা হয় এই উগ্রপন্থি বৌদ্ধ ভিক্ষুকে। তার অপপ্রচার এবং উস্কানিতে উগ্র বৌদ্ধরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যা করছে। আর রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচার তিনি দেড় দশক ধরে করে আসছেন। শুধু তাই নয়, অন্য অনেক বিষয়ে তিনি তার উগ্র মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। এমনকি তিনি জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লিকে ‘বেশ্যা’ বলে গালমন্দ করেছেন। ১৫ বছর আগেও এই বৌদ্ধ ভিক্ষু কারও কাছে পরিচিত ছিলেন না।

এই কুলাঙ্গার ১৯৬৮ সালে জন্ম গ্রহণ করে। ১৪ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে ভিক্ষু হন। ২০০১ সালে তিনি জাতীয়তাবাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ২০০১ সালে তিনি মুসলিমবিরোধী এবং জাতীয়তাবাদী একটি গ্রুপ গঠন করেন, যার নাম ৯৬৯ গ্রুপ। এ সংগঠনটিকে উগ্রপন্থি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাদের মূলমন্ত্র ‘৯৬৯’। এই তিন সংখ্যা বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক। বৌদ্ধ ধর্মে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ—এ তিন রত্নের নাম হলো ত্রিরত্ন। অর্থাৎ বুদ্ধরত্ন, ধর্মরত্ন ও সংঘরত্ন। বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ বলতে এখানে গুণাবলির গুণকীর্তন করা হয়েছে। ত্রিপিটকে বুদ্ধের প্রধান ৯টি গুণ, ধর্মের ছয় গুণ ও সংঘের ৯ গুণের কথা বলা হয়েছে। এমন বিশ্বাস থেকে এসেছে ‘৯৬৯’।

বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে ২০০৩ সালে তাকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১০ সালে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তাঁকেও ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সক্রিয় হন। তিনি ইউটিউব ও ফেসবুকে নানা ধরনের বক্তব্য ছড়াতে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বর্তমানে তাঁর ৪৫ হাজার ফলোয়ার আছে। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যে যখন তীব্র সংঘাত শুরু হয়, সে সময় আশ্বিন উইরাথু তার জ্বালাময়ী বক্তব্য নিয়ে জনসমক্ষে আসেন। তার একটি পরিচিত উক্তি ছিল, ‘তুমি যা-ই কর, সেটা একজন জাতীয়তাবাদী হিসেবে করবে।’ তাকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি ‘বার্মার বিন লাদেন’ কিনা? জবাবে উইরাথু বলেছিলেন, তিনি এ কথা অস্বীকার করবেন না।

২০১৩ সালের ১ জুলাই সংখ্যায় টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন ছেপেছে। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে বৌদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনী। তিনি নিজেকে মিয়ানমারের ‘বিন লাদেন’ আখ্যায়িত করে থাকেন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এর সন্ত্রাসী বাহিনী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চেয়ে শতগুণ বেশি নৃশংস।

৩। চিনের বিপুল বিনিয়োগ

৯০ এর দশকে চীন মিয়ানমারে কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ২০১৩ সালে চীনের কয়েকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান মিয়ারমারে তেল ও খনিজ সম্পদ উত্তোলনে বিনিয়োগ করে। চীন সরকার ইতিমধ্যে আরাকান রাজ্যের অবকাঠামো উন্নয়ন, বন্দর নির্মাণ এবং খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। মিয়ানমারের রাখাইনে ৭.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে গভীর সমুদ্রবন্দরের ৭০ শতাংশ অংশীদারিত্ব নিচ্ছে চীন। সমুদ্রবন্দরটি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত, একটি বন্দর, অন্যটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। বন্দর ছাড়াও রাখাইন রাজ্যের ওপর দিয়ে চীন কুনমিং পর্যন্ত সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার গ্যাস ও পাইপলাইন স্থাপন করেছে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, রাখাইন রাজ্য থেকে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের মূলে রয়েছে চীনের বাণিজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা। রাশিয়া এবং ভারতও এই সারিতে রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের মত। রাখাইন রাজ্য ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়ার এর প্রতি ভারতেরও দুর্বলতা রয়েছে। ভারতের লক্ষ্য রাখাইনে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ করা।

কৌশলগত বা ভূরাজনৈতিক কারণে আরাকান বা রাখাইন প্রদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে চমৎকার রাজ্য।রাখাইন প্রদেশের সিত্তুই জেলায় রয়েছে প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং সবচেয়ে বড় সমরঘাঁটি। মিয়ানমার সরকার মনে করে, এ রাজ্যের উন্নয়ন হলে রোহিঙ্গা মুসলিমরাও আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। এক সময় আরাকান ছিলো স্বাধীন রাজ্য। অতীতে রোহিঙ্গারা স্বাধীনতার জন্যে বারবার আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। এমতাবস্থায় দরিদ্র রোহিঙ্গা মুসলিমরা স্বচ্ছল হলে স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হবে এবং অদূর ভবিষ্যতে রাখাইন রাজ্য স্বাধীন মুসলিম রাজ্যে পরিণত হবে। এ কারণে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করছে।

৪। খনিজ সম্পদ উত্তোলন

রাখাইন প্রদেশে ইউরেনিয়ামসহ বেশ কিছু মূল্যবান খনিজ পদার্থের সর্ববৃহৎ খনি রয়েছে। ওইসব অঞ্চল থেকে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য অধিবাসীদের অন্যত্র সরানো দরকার। তাই দেশি-বিদেশি বেনিয়া চক্র সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে, যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে মিয়ানমারের ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী। আগস্ট-২০১৭ থেকে অক্টোবর-২০১৭ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে তা পূর্ব প্রণীত নীলনকশা অনুযায়ী হয়েছে।

৫। জমি দখল

রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের একটি কারণ হলো-মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গা মুসলিমদের জমি দখল ও জমি বাজেয়াপ্তকরণ। নব্বই এর দশক থেকে দেশটির সামরিক জান্তা কোন ক্ষতিপূরণ না দিয়ে জোর করে রোহিঙ্গাদের জমি দখল করছে। আগে সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে শুধু বলা হতো, ‘উন্নয়নের জন্য জমি নেওয়া হচ্ছে।’ পরে দেখা গেছে, ওই জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে সামরিক ঘাঁটি, প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধানের জন্যে অবকাঠামো, সরকারী কৃষি প্রকল্প ও পর্যটন কেন্দ্র। এ ধরণের উন্নয়নের অজুহাতে জোর পূর্বক জমি দখল করায় এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পাশের দেশে আশ্রয় নিয়েছে।

৬। সু চি-র প্রেমে ব্যর্থতা

মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপরে অং সান সু চির নির্যাতনের কারণ সু চি-র প্রেমে ব্যর্থতা। সু চি ১৯৬৪ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে পড়ার সময় তারেক হায়দার নামে এক পাকিস্তানী কূটনীতিকের সঙ্গে পরিচয় হয়। পাকিস্তানি সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে অক্সফোর্ডে পড়তে এসেছিলেন তারেক। সু চি প্রেমে পড়েছিলেন তারেকের। সু চির মা–ও ছিলেন কূটনীতিক। তাই তারেকের প্রেমে পড়তে সু চির সময় লাগেনি। সু চি-তারেকের মধ্যে ছিলো গভীর প্রেম।সু চির জীবনীকার বিখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক পিটার পপহ্যামও বলেছেন, ‘সংস্কৃতিগতভাবে অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সু চি এবং তারেক গভীর প্রেমে পড়েছিলেন।’ কিন্তু পরিণতি পায়নি সেই প্রেম।অনেকে ধারণা করেন, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে পড়েন সু চি।

১৯৬৫ সালে ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তারেককে খুশি করতে সু চি ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলাও বন্ধ করেছিলেন। প্রেম নিয়ে সু চি এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং এত বেশি সময় দিতেন যে অক্সফোর্ডে তৃতীয় বিভাগে কোনও রকমে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সু চি তারেককে বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু তারেক তাতে রাজী হননি। অক্সফোর্ডের পড়ালেখা শেষ হওয়ার পরে তারেক পাকিস্তানে ফিরে যান। এরপরে শোকে বিমর্ষ হয়ে পড়েন সু চি। তারেক বিহনে সু চি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হন। পিটার পপহ্যাম লিখেছেন, ‘সু চি প্রায় বছরখানেক বিরহে বিমর্ষ ছিলেন।’

সেই সময় থেকেই সু চি ধীরে ধীরে মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। তাই রোহিঙ্গা নির্যাতনের পিছনে সু চি’র প্রেমে ব্যর্থতাকেও দায়ী করেন অনেকে। 

আজ থেকে এখানে রাখছি। আমার পরবর্তী পর্বে স্বাগতম। ততক্ষণ পর্যন্ত ভালো থাকুন।


Comments

Popular posts from this blog

সোশ্যাল মিডিয়ার সুবিধা এবং অসুবিধা/সোশ্যাল মিডিয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

সমসাময়িক জীবনে ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ - একটি অনিবার্য উপাদান, বিশেষ করে যারা ব্যস্ত জীবন যাপন করেন এবং তথ্য আপডেটের জন্য এটির উপর নির্ভরশীল। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে লোকেরা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে, পরিবারের সাথে কথা বলতে পারে এবং অসংখ্য প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সমস্ত ঘটনা সম্পর্কে আপডেট থাকতে পারে। সবচেয়ে সাধারণ অনলাইন ক্রিয়াকলাপগুলির মধ্যে একটি হল সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা। একটি সমীক্ষা অনুসারে ২০২১ সালে প্রায় ৮২% আমেরিকানদের এক বা একাধিক সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইটে একটি প্রোফাইল ছিল, যা আগের বছরের ব্যবহারের হার থেকে ২% বেশি। ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২২৩ মিলিয়ন মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করত। সোশ্যাল মিডিয়ার সুবিধা/সোশ্যাল মিডিয়ার ভালো দিক কানেক্টিভিটি কানেক্টিভিটি সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলির মধ্যে একটি। এটি যেকোনো সময়, সর্বত্র অগণিত ব্যবহারকারীকে লিঙ্ক করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং এর সংযোগের মাধ্যমে তথ্য বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে, যা মানুষের একে অপরের সাথে যোগাযোগ করা সহজ...

কিওয়ার্ড কি, কত প্রকার, কিওয়ার্ড রিসার্চ কিভাবে করে ?

অনলাইন ক্ষেত্রে কিওয়ার্ড (keyword) বিশাল একটা জিনিস কারন একটা সামান্য keyword আপনার জীবন কল্পনাহীন পরিবর্তন করে দিতে পারে যদি আপনি ঠিকঠাক ভাবে খুঁজে পান। সুতরাং সবাই চায় সঠিক এবং ভালো কিওয়ার্ড নিয়ে কাজ করতে । আমাদের, keyword নিয়ে বিস্তারিত যেমন – কিওয়ার্ড কি, কিওয়ার্ড কত প্রকার, কিওয়ার্ড রিসার্চ কিভাবে করে, কিওয়ার্ড স্টাফিং কি জেনে নেওয়াটা অনেক বেশি জরুরি সাথে জেনে নেওয়া দরকার কিওয়ার্ড রিসার্চ কিভাবে করে, কিওয়ার্ড রিসার্চ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভালো বাংলা কিওয়ার্ড রিসার্চ টুল কোণগুলো। কিওয়ার্ড-keyword-কি-কত-প্রকার-কিওয়ার্ড-রিসার্চ-কিভাবে-করে সূচিপত্র 1 কিওয়ার্ড(keyword)কি 2 কিওয়ার্ড কত প্রকার(types of keywords) 2.1 ক. অভিপ্রায় ভিত্তিক প্রকার (Based On Keyword Intend ) – 2.1.1 ১. মার্কেটিং কিওয়ার্ড(marketing) 2.1.2 ২. ব্রান্ড বেসড কিওয়ার্ড (brand) 2.1.3 ৩. লোকেশন বেসড কিওয়ার্ড (geo-targeting) 2.1.4 ৫. কম্পিটিশন বেসড কিওয়ার্ড(competitor) 2.1.5 ৬. কাস্টমার বেসড কিওয়ার্ড (customer centric) 2.2 খ. কিওয়ার্ড দৈর্ঘ্য নির্ভর ভাগ (based on length) 2.2.1 ১. Short-tail keyword ...

প্রসেসর কি? প্রসেসর কিভাবে কাজ করে?

প্রসেসর কম্পিউটারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা এটাকে CPU বা সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট বলে জানি। কম্পিউটারের এই অংশটি মূলত আমাদের কমান্ড প্রসেস করে এবং আউটপুট দেয়। প্রসেসরকে বলা হয় কম্পিউটারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ প্রসেসিং ইউনিট ছাড়া আমরা কম্পিউটারের কোনো ধরনের কাজ করতে পারি না। আজ আমরা এই ব্লগ পোস্টে জানবো প্রসেসর কি, কিভাবে কাজ করে, এর গঠন কি এবং প্রসেসর কি কি। তো চলুন শুরু করা যাক আমাদের আজকের ব্লগ পোস্ট। আশা করি এই ব্লগ পোস্টটি পড়ার পর আপনি প্রসেসর সম্পর্কে আপনার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। প্রসেসর কি? প্রসেসর হল আমাদের ফোন বা ল্যাপটপে এক ধরনের বিশেষ হার্ডওয়্যার যা আমাদের নির্দেশ বা ইনপুট গ্রহণ করে এবং আমাদের ডিসপ্লের সামনে আউটপুট হিসেবে প্রদর্শন করে। সহজ ভাষায় যিনি প্রসেস করেন তিনি প্রসেসর। অর্থাৎ, আমাদের নির্দেশগুলি প্রসেস করে ভিজ্যুয়াল আকারে আমাদের কাছে আনা হয়। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের মতো ইলেকট্রনিক ডিভাইসে প্রসেসর ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। প্রসেসর ছাড়া এই দুটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস একেবারেই অচল। প্রসেসর হল এক প্রকার গাণিতিক ইঞ্জিন। কারণ এটি একটি স্বয়ংসম্পূ...