ক্রোধ কি? - ক্রোধ দমনের বৈজ্ঞানিক কৌশল
ক্রোধ হল একটি স্বাভাবিক তীব্র মানসিক অবস্থা যা আঘাত করা অনুভূতির জন্য একটি শক্তিশালী অস্বস্তিকর এবং অসহযোগিতার প্রতিক্রিয়া। ক্রোধের সম্মুখীন ব্যক্তি প্রায়ই মানসিক অবস্থার পাশাপাশি শারীরিক প্রভাবও অনুভব করেন। যেমন হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি, উচ্চ রক্তচাপ এবং অ্যাড্রেনালিন এবং নরড্রেনালিনের মাত্রা বৃদ্ধি। কেউ কেউ রাগকে একটি আবেগ হিসাবে দেখেন যা অস্বস্তিকর উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রাগের বাহ্যিক অভিব্যক্তি মুখের অভিব্যক্তি, শরীরের ভাষা, শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া এবং কখনও কখনও জনসমক্ষে আগ্রাসনে পাওয়া যায়। যাইহোক, যারা রাগ অনুভব করেন তাদের বেশিরভাগই রাগের কারণ উল্লেখ করেন। তবুও একজন রাগান্বিত ব্যক্তি বড় ভুল করতে পারে কারণ রাগ আত্ম-পর্যবেক্ষণ এবং বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনিয়ন্ত্রিত রাগ ব্যক্তিগত বা সামাজিক মঙ্গলকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
ক্রোধের সময় কী ঘটে দেহে - ক্রোধ দমনের বৈজ্ঞানিক কৌশল
- ব্রেন সিগন্যাল পাঠায়।
- ঝড়োগতিতে নিঃসরণ ঘটে সক্রিয় হরমোন নর-এড্রিনালিন।
- নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়, গভীর হয়।
- রক্তচাপ বেড়ে যায়।
- চোখের মণির স্ফীতি ঘটে।
- রক্ত প্রবাহ শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে হৃদপিন্ড, মস্তিষ্ক এবং পেশীতে ছুটে যায়।
- হজমক্রিয়া থেমে যায়।
- রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়।
- হাতের মুষ্টি ক্লেঞ্চ হয়ে আসে, দাঁত খিঁচিয়ে আসে, পরিপাকতন্ত্র খামছে ধরে।
- ক্রোধের সময় শরীরে বিপদ সংকেত বা লাল আলো জেগে ওঠে।
ক্রোধ প্রশমন - ক্রোধ দমনের বৈজ্ঞানিক কৌশল
সাম্প্রতিক মনোগবেষণা থেকে জানা যায়, ক্রোধ পোষ মানানোর যেসব সনাতন পদ্ধতি চলে আসছিল তা সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। একটি বালিশ বা নরম কিছুতে ঘুষি মারার মতো শারীরিক ভঙ্গির মাধ্যমে রাগ প্রকাশের জনপ্রিয় কৌশল, যদিও এই পদ্ধতিগুলির সাময়িক ইতিবাচক ফলাফল রয়েছে, এই পদ্ধতিগুলি মূলত পরিস্থিতি থেকে আড়াল করার আমাদের প্রবণতাকে জড়িত করে।
বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ইত্যাদি চিকিৎসায় সাফল্যের সঙ্গে কগনেটিভ বিহেভিয়ার থেরাপির সুনির্দিষ্ট প্রটোকল ব্যবহার করা হয়। ক্রোধের ক্ষেত্রেও একই কৌশলে রাগ শাসন করার কৌশল রপ্ত করা যায়।
ক্রোধ দমনে নতুন কিছু কৌশল
- পরিস্থিতি সরাসরি মোকাবিলা করতে হবে
অধৈর্য বা বিরক্তি সৃষ্টি করে এমন ঘটনাগুলো প্রথমে নিখুঁতভাবে শনাক্ত করুন। নোট করে রাখুন। পরবর্তীকালে শান্ত থেকে দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেকে এক্সপ্রেস করুন। তাড়াহুড়ো বা সজোরে পরিস্থিতির ভিতর নিজেকে ছুড়ে দেওয়া নয়, অপরকে দোষারোপ করাও নয়, এমনকি বিতর্কিত শব্দ ব্যবহার করা থেকেও নিজের জিহ্বাকে শাসন করতে হবে এ সময়। মনে রাখুন, ক্রোধের সময় ছুড়ে দেওয়া শব্দগুলো আপনার দেহ ও মনে স্ট্রেস রিএকশন ঘটায়। এ রিএকশন মানেই দেহের ক্ষতি, মনের ক্ষতি, ব্রেনের ক্ষতি, হার্টের ক্ষতি।
- দশ পর্যন্ত গণনা
উন্মত্ততার সময় এ প্রক্রিয়াটি চর্চা করার কৌশল রপ্ত করে নিন। ধীরে ধীরে চর্চা করতে হবে। গভীর টানে প্রশ্বাস নিন। ছাড়ুন নিঃশ্বাস। অথবা রাগ উতরে ওঠার ঘটনা থেকে মুহূর্তের জন্য দূরে সরিয়ে নিন নিজেকে। এর অর্থ এই নয় যে, পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে গেলেন। শান্ত হলেই আবার ফিরে আসুন।
- হাস্যরসের উপাদান
রসবোধই মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী ঘটনা থেকে আপনাকে খানিকটা দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে। ঘটনার ভেতরই ঘুরপাক খেয়ে দেখুন কৌতুকের কিছু উপাদান পাওয়া যায় কিনা। রাগ তরল করার জন্য রসবোধ পরিস্থিতি থেকেই খুঁজে বের করা যায়।
- চিন্তার গণ্ডি বাড়ান
কোনো কোনো চিন্তা নিজের মাঝে ক্ষোভ জাগাতে পারে। বিক্ষুব্ধ করতে পারে। প্রথমে চিন্তাগুলোর জটিল গিঁট থেকে বিকল্প চিন্তার পথ বের করে নিতে হবে। এরপর পাল্টা এগ্রেশন জাগে এমন পরিস্থিতিগুলো পরিবর্তনের চেষ্টা চালাতে হবে।
- ক্রোধবিষয়ক বই রাখুন
যখন নিজের মাঝে ক্রোধের উন্মত্ততা জাগবে, ১০ ডিগ্রি রাগের স্কেলে, তা মেপে নিন। যদি স্কোর ৪ বা ততোধিক হয়, পরিস্থিতি বিষয়ক চিন্তা এবং দৃশ্যমান ইমেজগুলো নোট করে রাখুন। ক্রোধের মেয়াদকাল, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি কি কি, বিস্তারিত লিখে রাখুন। কী পদ্ধতিতে, কী পরিস্থিতিতে, কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, পুরো বিষয়টি তখন আপনার কাছে খোলাসা হয়ে যাবে।
- নিজের প্রতি ফিরে তাকাতে হবে
ক্রোধের কারণে নিজ জীবনে কতটুকু মূল্য দিতে হয়েছে একবার নেড়েচেড়ে দেখুন। রাগের কারণে কি কোনো মধুর সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে? ভেঙে গেছে? কর্মক্ষেত্রে কি কোনো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে? ফলশ্রুতিতে কি কোনো ধরনের দৈহিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া ঘটেছে? বাস্তব প্রমাণ হাতে এলে, মূল্যায়ন সঠিক হবে। নিজেকে সামাল দেওয়ার কৌশল ভিতর থেকেই আপনাকে তখন রক্ষা করবে।
রাগ নিয়ন্ত্রণে ইসলামের নির্দেশনা- রাগ কীভাবে কমানো বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
আমরা পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে রাগ নিবারণের কার্যকর পন্থা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে রাগ নিবারণের উপায়ের পদ্ধতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো-
প্রথমত: অন্যের ভুল-ভ্রান্তিকে মার্জনার দৃষ্টিতে দেখা। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ (তারা সফল মানুষ) যারা অন্যায় ও পাপকর্ম থেকে নিজেদেরকে বিরত রাখে এবং যখন ক্রোধান্বিত হয় তখন আত্মসংবরণ (তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়) করে। ’ –সূরা আশ শুরা: ৩৭
দ্বিতীয়ত: তাকওয়া ও পরহেজগারিতা। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে তাদেরকে তাকওয়া ও পরহেজগারি হিসেবে অভিহিত করেছেন; যারা ক্রোধকে দমন করতে পারে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে যে, ক্রোধ দমনের সক্ষমতাই তাকওয়া ও পরহেজগারিতার পরিচয়।
পবিত্র কোরআনের ভাষায়, ‘আর তোমাদের প্রতিপালকের মার্জনা ও বেহেশতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও, যার বিস্তৃতি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমান; যা তাকওয়াধারীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে, ক্রোধ সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল। আর সৎকর্মশীলদের আল্লাহ ভালোবাসেন। -সূরা আল ইমরান : ১৩৩-১৩৪
সাধারণত আমরা দেখি যে যখন একজন ব্যক্তি জীবনের পথে বাধা বা বাধার সম্মুখীন হয় - যদি সে ধৈর্য্য না ধারণ করে, তখন ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে।
তৃতীয়ত: ‘আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম’ (আমি অভিশপ্ত শয়তানের হাত থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি) বেশি বেশি পাঠ করা। নিশ্চয়ই অভিশপ্ত শয়তান মানুষের অন্তরে ক্রোধের আগুন প্রজ্বলিত করে। কাজেই ক্রোধের আগুন থেকে বাঁচার অন্যতম কার্যকর পন্থা হচ্ছে, আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা। যাতে শয়তানের প্ররোচনা হতে নিরাপদ থাকা যায়।
চতুর্থত: ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম’ পাঠ করা। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিয়্যিল আজিম’- পাঠের মাধ্যমে ক্রোধ নির্বাপিত হয়।
পঞ্চমত: অধিক দরুদ শরিফ পাঠ করা। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি দরুদ শরিফ পাঠ মানুষের আত্মাকে প্রশান্ত এবং ক্রোধকে নিবারণ করে।
ষষ্ঠত: রাগ ও ক্রোধ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার অন্যতম উপায় হচ্ছে, মানুষ যখন রাগান্বিত হয়, তখন তার উচিত সিজদাবনত হওয়া। কেননা সিজদা ক্রোধের আগুনকে নির্বাপিত করে। এ সম্পর্কে ইসলামি স্কলাররা বলেন, ক্রোধ হচ্ছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায়। যা মানুষের মন ও মানসিকতার ওপর (নেতিবাচক) প্রভাব ফেলে। এ অবস্থাতে দেখা যায়, ক্রোধান্বিত ব্যক্তির চোখ রক্তবর্ণ হয়ে যায়। কাজেই যদি কারও মধ্যে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়- তাহলে তার উচিত সেজদাবনত হওয়া। যে ক্রোধান্বিত অবস্থায় সেজদাবনত হবে, আল্লাহতায়ালা তাকে শয়তানের প্রজ্বলিত আগুন থেকে রক্ষা করবেন এবং তার অন্তরে প্রশান্তি সৃষ্টি হবে।
সপ্তমত: অবস্থার পরিবর্তন সাধন। বলা হয়, যদি কেউ বসা অবস্থায় ক্রোধান্বিত হয় তাহলে উঠে দাঁড়াবে। যদি দাঁড়ানো অবস্থায় ক্রোধের শিকার হয়- তাহলে বসে যাবে কিংবা নিজের স্থান পরিবর্তন করবে। এক্ষেত্রে কিছুটা হাটাহাটি করার কথাও বলা হয়েছে। অবস্থার এমন পরিবর্তনের মানুষের ক্রোধের আগুন প্রশমিত হয়।
অষ্টমত: অজু কিংবা গোসল করা। ক্রোধের আগুন নিবারণের জন্য হাত-পা ধৌত করা অর্থাৎ অজুর আমল ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কাজেই অজু কিংবা গোসল এক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর প্রভাব ফেলে। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যখন তোমাদের মধ্যে কেউ ক্রোধান্বিত হও; তখন অজু কিংবা গোসল করবে। কেননা ক্রোধ হচ্ছে- অগ্নি। আর পানি অগ্নিকে নির্বাপিত করে দেওয়া।
আপনার রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য আরো কিছু কাজ করতে পারেন-
- প্রথমত আপনাকে চুপ থাকতে হবে।
- অন্য কোনো ভালো স্মৃতি মনে করতে হবে।
- রাগ কেন্দ্রিক বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে হবে।
- এক গ্লাস পানি পান করুন।
- একটু হাঁটুন।
- একজায়গায় স্থির হয়ে বসুন।
- কমপক্ষে ১০মিনিট অপেক্ষা করুন এবং তারপরে কথা বলুন।
- প্রতিবাদ করার চেয়ে প্রতিরোধ করাটাই উত্তম।
- পছন্দের খাবার খেতে পারেন।
- ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করতে পারেন।
- অযথা তর্কে জড়াবেন না।
- চলন্ত অবস্থায় থাকলে স্থির হয়ে যাবেন।
- দাড়ানো অবস্থায় থাকলে যথাসম্ভব বসে যাবেন।
- মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলুন।
- যথাসম্ভব ভদ্রতার সহিত কথা বলবেন।
- হেরে যেতে শিখুন এবং অন্যকে জিতিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন।
আশা করি আপনার অতিরিক্ত রাগ কিছুটা প্রশমিত হতে পারে।
Comments
Post a Comment