প্রতিটি পরিবারই শিশুদের ভালোবাসে। শিশুদের মধ্যে ভালো অভ্যাস গড়ে উঠুক সেটা কে না চায়? কিন্তু কোন বয়সে কীভাবে শিশুকে লালন পালন করলে ভালো অভ্যাসগুলো তৈরি করা যায়, সেটা আমাদের অনেকেরই সঠিকভাবে জানা থাকে না। কিছু নির্দেশনা অনুসরণ করে খুব সহজেই শিশুর মধ্যে আদব-কায়দা, নিয়ম-শৃঙ্খলা ও ভালো অভ্যাস গড়ে তোলা যায়।
আমরা যদি একটি চারাগাছের তাকাই তাহলে কি দেখবো? চারাগাছকে মাটির সঙ্গে রোপন করার জন্য চাই বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যা। তবে একবার চারাগাছটি মাটির সঙ্গে শক্তভাবে গেঁথে গেলে পরবর্তী সময়ে গাছটির জন্য বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয় না। তা না হলে বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যার অভাবে গাছটি দুর্বলভাবে বেড়ে ওঠে। মানবশিশুর ক্ষেত্রেও কথাটি একইভাবে প্রযোজ্য। জন্মের প্রথম বছরগুলোতে শিশুর প্রতি মনোযোগ, শিশুকে সময় দেয়া, ভালো অভ্যাস শিশুর সারা জীবনের ভিত্তি তৈরি করে। কারণ শিশুরা তাদের বাবা-মাকে দেখেই তাদের অভ্যাসগুলো রপ্ত করতে শেখে, জীবনে উন্নতি লাভ করে। বাবা-মায়েরাই সব সময় তাদের শিশুদের জন্য প্রথম উদাহরণ হন। তারা এমন একজন- শিশুরা কোনো সমস্যায় পড়লে যাদের কাছে যায়, তাদের স্বভাব ও অভ্যাসগুলোই শিশুরা তাদের জীবনে প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করে। বড় হয়ে শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের আচরণ এবং কাজকর্মকে অনুকরণ করে এবং বাবা-মায়েরাই তাদের সন্তানদের জন্য রোল মডেল হন। তাদের জ্ঞান ও অভ্যাসগুলো বাচ্চাদের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। সুতরাং, ভালো এবং খারাপ অভ্যাসগুলোর মধ্যে পার্থক্য করতে এবং সেগুলোর মধ্যে থেকে ভালোটিকে বেছে নিতে শিশুকে শিক্ষা দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।
একজন অভিভাবক হিসেবে আপনার একটা বড়ো দায়িত্ব হলো আপনার শিশুদেরকে সু–আচার আচরণের গুরুত্বগুলিকে বোঝানো এবং সেগুলির সাথে তাদেরকে বেড়ে তোলা নিশ্চিত করা।আপনার সন্তানকে সু–অভ্যাসগুলি শেখাতে সঠিক পথে চালনা করতে আপনি নিম্নলিখিত সংকেতগুলিকে কাজে লাগাতে পারেন।
- এর প্রথম পদক্ষেপটি হল সমস্ত ভাল অভ্যাসগুলিকে নিজের মধ্যে আয়ত্ত করা। বাচ্চারা তাদের মা–বাবাকে তাদের রোল মডেল হিসেবে দেখে, তাই তারা যাকিছু তাদের থেকে দেখে অনুকরণ করার চেষ্টা করে। আপনি যদি চান যে আপনার সন্তানের মধ্যে শিষ্টাচারগুলি গড়ে উঠুক, তবে আপনি তাদের কী শেখাতে চান তা তাদের সামনে অনুশীলন করুন। হতাশার সময়েও বাচ্চাদের সামনে আপনার ভালো আচরণ, শিষ্টাচার, ভাল আদব–কায়দা দেখাতে ভুলবেন না। ।
- ভদ্র ও বিনয়ী হওয়া, দরজায় কড়া নাড়া, কাজের পরে গুছিয়ে রাখা এবং নিজেকে পরিপাটি ও পরিষ্কার রাখা, খাবার টেবিলের আচার-ব্যবহার ইত্যাদির মতো ভালো অভ্যাসগুলি আপনার সন্তানের সাথে বারবার অনুশীলন করা যেতে পারে যতক্ষণ না এটি তাদের মনে এবং আচরণে দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায়।
- আপনার সন্তান যখন সঠিকভাবে কিছু করে বা ভালো ব্যবহার করে, তখন ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার করে তাদের প্রশংসা করতে ভুলবেন না এবং প্রতিবার যখন তারা ভালো কিছু করে তখন তাকে উৎসাহিত করা তাদের ভালো হতে সাহায্য করবে।আপনার সন্তানের ভাল আচরণ এবং ভাল আচরণ উপেক্ষা করা বিপরীত প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ তারা আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য খারাপ আচরণ করতে পারে।
- আপনার ছেলে বা মেয়ে যখন ভুল করে তখন তাকে সংশোধন করুন, এমনকি তা অন্য কারো সাথে কথোপকথনের মাঝখানে হলেও। আপনার সন্তানকে কিছু মুহুর্তের জন্য থামান এবং দ্রুত তার ভুল সংশোধন করুন। কিন্তু আপনার সন্তান যদি খুব আত্মসচেতন হয়, তাহলে আপনি তাকে পরে একান্তে বলতে পারেন।
- বাচ্চাদের কম মনোযোগ এবং কর্মচঞ্চলতার মন আপনাকে হয়ত একাধিক বার বিরক্ত ও হতাশ করে তুলবে, কিন্তু ধৈর্যশীল হন।কখনও ধৈর্যচ্যুত না হয়ে ওঠা এবং আপনার সন্তানের উপর রেগে না যাওয়া উচিত। আপনি যদি শান্ত এবং দৃঢ় থাকেন তবে আপনার সন্তানও একই আচরণ করবে।
- আপনি যদি শিশুদের অন্যান্য ধর্ম, গোষ্ঠী, লিঙ্গ এবং জাতীর লোকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখান তবে সেই একই পক্ষপাতিত্ব নিজের বেলাতেও করাটা নিশ্চিত করুন। আপনার সন্তানদের শেখান একজন মানুষকে শুধুমাত্র তার চরিত্র দিয়ে বিচার করতে, অন্য কিছু কিছুর দ্বারা নয়।
- আপনার শিশুর সাথে ও তার আশেপাশে সর্বদা বিনয়ী হয়ে কথা বলুন এবং কোনওরকম অশ্লীল শব্দ বা ভাষা ব্যবহার করবেন না। কোনও বাচ্চাকে শিষ্টাচার শেখানোর ক্ষেত্রে প্রথম কয়েকটি প্রাথমিক শব্দ হওয়া উচিত ‘দয়া করে‘, ‘ধন্যবাদ‘, ‘দুঃখিত‘, ‘আমি কি‘ এবং ‘অক্সকিউজমি‘। আপনার বাচ্চার সাথে কথা বলার সময় বারংবার এই শব্দগুলি ব্যবহার করুন এবং তাদেরকেও উৎসাহিত করুন সেই শব্দগুলি আপনার সাথে ব্যবহার করার জন্য।এটাকে আপনার বাড়ির একটা নিয়ম করে তুলুন আর তাতেই আপনার বাচ্চা এই সকল সু–অভ্যাস এবং শিষ্টাচারগুলিকে নিজের মধ্যে রপ্ত করে তা অভ্যাস করে ফেলবে।
- ভাল আচার–আচরণগুলি হল মৌলিক উপাদান যা আপনার বাচ্চাদের মধ্যে শিষ্টাচারের অনুভূতি জাগিয়ে তুলবে এবং বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের আরও ভাল মানুষ হিসাবে গড়ে তুলবে। তারা লোকজনের সাথে সহজে মিশতে শিখবে, কর্মক্ষেত্রে বা স্কুলে সাফল্য অর্জন করবে এবং আশেপাশের অন্যদের সাথেও সুসম্পর্ক গড়ে তুলবে। একজন বিনয়ী, নম্র ও বিবেচক শিশু বিশ্বের উপর সেরা ছাপটিই ফেলবে।সুতরাং, আপনার শিশুদেরও একদম ছেলেবেলা থেকেই এই শিষ্টাচারগুলি শেখানো শুরু করুন!
- শিশুদের শেখার জন্য সময় প্রয়োজন। অভিভাবকদের কিছু শেখানোর জন্য তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়। সময় ভালো ফলাফল দেয়। তাড়াহুড়া শিশুর মধ্যে হতাশার জন্ম দিতে পারে। তিনি অনুভব করেন যে তিনি শিখতে পারেন না, যা তাকে বিরক্ত করে। শিশুকে জোর করে খাওয়ানো, ঘুমানো, টয়লেটের জন্য জোরাজোরি বা চাপাচাপি করা উচিত নয়। আমাদের অধিকাংশ অভিভাবক আমাদের সন্তানদের শেখানোর ক্ষেত্রে খুব ধৈর্যশীল নন। অনেক সময় আমরা রেগে যাই, চিৎকার করি, হুমকি দিই, চড়-থাপ্পড় দিই। এটি শিশুর শেখাটা আরও পিছিয়ে দেয়।
- একটি শিশুকে শৃঙ্খলা শেখানোর চেষ্টা করার সময়, সেই নিয়মটি যাতে ভঙ্গ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক- তা শিশুর সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়। একই কাজকে কখনো ভালো কখনো মন্দ বলা যায় না। যেমন মিথ্যা বলা ঠিক নয়। ছোট-বড় যেকোনো কাজ বা যেকোনো সময় করা অনুচিত বা খারাপ তা শিশুদের বোঝা উচিত। তখন তার মধ্যে কোনো বিরোধ থাকে না। শিশুকে যা শেখানো হবে তা যেন কথার কথা না হয়। শিশুদের জন্য সঠিক আচরণ এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা একটি যুদ্ধের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু পরিবারের অভিভাবক হিসেবে আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং তাদের সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। এটা অস্বীকার করার কোন কারণ নেই যে আদর্শ পিতা-মাতাই আদর্শ সন্তানের মূল নির্মাতা। পিতামাতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিশুরা আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। তাদের সম্পর্ক নিঃশর্ত ভালোবাসার। কিন্তু সেই প্রেমে স্নেহ ও শৃঙ্খলার যথাযথ সমন্বয় রয়েছে। একজন আদর্শ অভিভাবক হতে হলে এই সম্প্রীতি বজায় রাখা খুবই জরুরি। কিভাবে এটি বজায় রাখা যায়, আপনার সদিচ্ছা এবং ইচ্ছাশক্তি সবচেয়ে সহায়ক শক্তি হতে পারে।
- শিশুর পরিবারের সবার সাথে মেলামেশা করার এবং আগত অতিথিদের আপ্যায়ন করতে সাহায্য করার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত । এটি দরজা খোলা থেকে শুরু করতে পারে, এবং খাবার পরিবেশন করতে পারে। বয়স্কদের সাহায্য করা শেখানো উচিত। যদি কেউ ভুলবশত এটি ফেলে দেয় তবে বাচ্চাদের সেই জিনিসটি তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন করা উচিত। বাচ্চারা ভালো কিছু করলে আমরা তাদের প্রশংসা করি। তাকে প্রশংসা করতেও শেখাতে হবে। কারো ভালো কাজ দেখলে তার প্রশংসা করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শিশুকে অল্প বয়সেই ছোটদের আদর করে সম্পর্ক গড়ে তুলতে শেখাতে হবে। রাগ করার খারাপ দিক শিখিয়ে রাগ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শিশুদের জন্য একটি পরিষ্কার পরিবেশ অপরিহার্য। তাদের পরিবেশ রক্ষা করতে শেখানো উচিত। ময়লা ফেলা এড়িয়ে চলতে হবে। নির্দিষ্ট স্থানে আবর্জনা ফেলার অভ্যাস গড়ে তুলুন। বাড়িতে গাছ লাগানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হবে। শিশুকে গাছে নিয়মিত পানি দেওয়ার বিষয়ে বোঝাতে হবে। শিশুরা গাছ ভালোবাসলে আমাদের পৃথিবী সুন্দর হবে। শিশুদের শেখাতে হবে অপচয় না করতে। কাজ শেষে ফ্যান-লাইট বন্ধ করার অভ্যাস করুন। পানির অপচয়ের পরিণতি ব্যাখ্যা করতে হবে। শিশুদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
Comments
Post a Comment