শ্রম দিয়ে কিংবা মেহনত করে যারা জীবিকা অর্জন করে তাদেরকে বলা হয় শ্রমিক, মজদুর বা মেহনতী মানুষ। ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অপরিসীম। ইসলামে শ্রমের মর্যাদা যেমন দেওয়া হয়েছে, তেমনি শ্রমিকেরও মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন— ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রমনির্ভর করে।’ সূরা বালাদ:৪। শ্রম দ্বারা যে মানুষ হালাল জীবিকা উপার্জন করে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে আল্লাহর বন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
একজন শ্রমিক তার শ্রমের মূল্য যাতে প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে পায় এমনটিই নিশ্চিত করা হয়েছে ইসলামী বিধানে। এ সম্পর্কে রাসুল (সাঃ)নির্দেশ দিয়েছেন— ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করতে হবে।’ (সুনামে ইবনে মাজাহ)।
শ্রমিক নিয়োগের পূর্বে শ্রমের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। রাসূল (সাঃ) শ্রমিকের পারিশ্রমিক নির্ধারণ না করে শ্রমিক নিয়োগ দিতে নিষেধ করেছেন। (নাসায়ি)।
শ্রমিকদের ওপর সাধ্যাতীত কাজ চাপিয়ে দেয়া জুলুম। রাসূল (সাঃ)বলেছেন, অধীনস্থদের জন্য খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করবে, তাদের ওপর সাধ্যাতীত কাজ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। (মুসলিম)।
ইসলাম শ্রমিকের সঙ্গে সদাচরণের শিক্ষা দেয়। শ্রমজীবীদের প্রতি নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) কতটা দরদী ছিলেন তার প্রমাণ মেলে একটি ঘটনায়। জনৈক ব্যক্তি রাসুল (সাঃ)-কে বললেন, আমার খাদেম (গৃহ পরিচারক/গৃহ শ্রমিক) আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অন্যায় করে, (এখন আমি তার সঙ্গে কেমন আচরণ করব?) রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘দৈনিক তাকে সত্তর বার ক্ষমা করবে।’ অর্থাৎ গৃহ শ্রমিক মালিকের সাথে দুর্ব্যবহার করলেও রাসূল (সাঃ) মালিককে প্রতিশোধ নেয়ার অনুমতি দেয়নি।
মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) নিজে কৃষিকাজ করে সংসার নির্বাহ করতেন। তিনি এবং হযরত হাওয়া (আঃ) সেলাই, কাপড় বুনন, কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি প্রভৃতি নিজেদের শ্রমের দ্বারাই করতেন।
মহানবী (সাঃ) নিজে পানি বহন করতেন। নিজের জুতা নিজেই সেলাই করতেন। মসজিদ নির্মাণ, পরিখা খননসহ সামাজিক কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। খাদেমদের সাথে একসাথে খেতেন।
কোরআনের দৃষ্টিতে
১।‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) সন্ধান করবে।’ সূরা জুমায়া:১০
২।‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি শ্রমনির্ভর করে।’ সূরা বালাদ: ৪।
হাদীসের দৃষ্টিতে
- রাসুল(সাঃ)নির্দেশ দিয়েছেন— ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করতে হবে।’ (সুনামে ইবনে মাজাহ)।
- তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা (কর্মচারী) তোমাদের ভাই, আল্লাহ যে ভাইকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন তাকে তাই খেতে দাও যা তুমি নিজে খাও, তাকে তাই পরিধান করতে দাও যা তুমি নিজে পরিধান কর। -সহিহ বোখারি
- মহানবী সা. তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন, ‘যে ব্যক্তি একজন শ্রমিক নিয়োগ করে তার কাছ থেকে পরিপূর্ণ কাজ আদায় করে কিন্তু তাকে তার মজুরি পরিশোধ করে না। (বুখারি)
- আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, কেউ তার অধীনস্তকে (কর্মচারীকে) অন্যায়ভাবে এক দোররা মারলেও কিয়ামতের বিচারের দিনে তার থেকে এ বদলা নেয়া হবে। অর্থাৎ মালিককে দোররা মারা হবে। -তাবরানি
- হজরত ওমর (রা.) বলেন, যৌবনকালে যে ব্যক্তি শ্রম দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের খেদমত করেছেন বৃদ্ধকালে সরকার তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি দিতে পারে না। -ইবনে মাজা
- মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর, কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না। -মুসনাদে আহমাদ
- যদি আপনার দাস আপনার খাবার প্রস্তুত করে আপনার কাছে নিয়ে আসে, তবে রান্নার সময় আগুনের তাপ এবং ধোঁয়া তাকে খুব কষ্ট দিয়েছিলো, তাই তাকে সেই খাবার আগে খাওয়াবে। খানা যদি অল্প হয় তবে তার হাতে এক মুঠো, দু’মুঠো অবশ্যই তুলে দিবে। -মুসলিম
- উমর ইবনে হুরাইস (রা.) হতে বর্ণিত নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা তোমাদের কর্মচারীদের থেকে যতটা হাল্কা কাজ নিবে। তোমাদের আমলনামায় ততটা পুরস্কার ও পুণ্য লেখা হবে।
- হজরত জুবায়ের (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) খাদেমের সঙ্গে বসে খেতে বলেছেন।
- হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন আমার দাস, আমার দাসী না বলে। কেননা আমরা সকলে আল্লাহর দাস-দাসী।
- রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : অধীনস্থ চাকর-বাকর ও দাস-দাসীদের প্রতি ক্ষমতার বলে খারাপ আচরণকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনি কি আমাদের বলেননি যে, অন্যান্য জাতির তুলনায় এ জাতিতে ক্রীতদাস ও এতিমের সংখ্যা বেশি হবে? তিনি বলেন, হ্যাঁ। অতএব, তোমরা তাদের তোমাদের সন্তানদের মতো আদর-যত্ন করবে এবং তোমরা যা খাবে, তাদের তাই খাওয়াবে। (ইবনে মাযা)
- এক ভাষণে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছি যে, গোলামের (কর্মচারীর) সঙ্গে ভালো আচরণ করবে এবং তাদের কোনো প্রকার কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জান না যে, তাদেরও একটি অন্তর আছে, যা কষ্ট পেলে ব্যথা পায় এবং আরাম পেলে আনন্দিত হয়। তোমাদের কি হয়েছে? তোমরা তাদেরকে হীন মনে কর এবং তাদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর না।
নবীদের পেশা
নবী রাসূলরাও শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। তারা বিভিন্ন পেশায় শ্রম দান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নিম্নে নবী-রাসূলদের পেশা বর্ণনা করা হলোঃ
- হজরত আদম (আ.) কৃষক ছিলেন।
- হজরত নূহ (আ.) সুতার (কাঠ মিস্ত্রি) ছিলেন।
- হজরত দাউদ (আ.) কর্মকার (কামার) ছিলেন।
- হজরত ইদরিস (আ.) দর্জি ছিলেন।
- হজরত জাকারিয়া (আ.) ছিলেন একজন সুতার বা কাঠ মিস্ত্রি।
- হজরত ইবরাহিম (আ.) রাজমিস্ত্রি ছিলেন।
- হজরত ইসমাঈল (আ.) রাজমিস্ত্রির সহকারী (যোগাড়ী) ছিলেন।
- হজরত মূসা (আ.) ছাগলের রাখাল ছিলেন।
- আল্লাহর রসূল, হজরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাগল পালন, ব্যবসা, কূপ থেকে পানি তোলা এবং মানুষের বাগানে কাজ করে উপার্জন করতেন।
Comments
Post a Comment